আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনার স্বপ্ন আমার মনে অনেক দিন ধরেই ছিল। ডাবলিনের সবুজ প্রকৃতি, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়, আর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের কথা শুনে আমি ঠিক করলাম এখানে পড়তে আসব। কিন্তু স্টুডেন্ট ভিসার প্রক্রিয়া, খরচ, আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রথমে অনেক দ্বিধায় ছিলাম। আজ আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা, এর খরচ, আবেদন প্রক্রিয়া, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করবো। আমার লক্ষ্য হলো আপনার জন্য পথটা সহজ করা, যাতে আপনি আপনার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।

আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা কী এবং কেন বেছে নেবেন?

আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা (ইংরেজিতে Stamp 2) হলো এমন একটি ভিসা, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বা ইংরেজি ভাষার কোর্সে পড়ার অনুমতি দেয়। আমি যখন প্রথম এই ভিসার জন্য খোঁজ নিই, তখন বুঝতে পারি আয়ারল্যান্ড অনেক কারণে আকর্ষণীয়। এখানকার শিক্ষার মান খুব উঁচু, এবং পড়াশোনার পাশাপাশি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পার্ট-টাইম কাজ করার সুযোগ আছে। আমার জন্য এটি ছিল বড় একটি সুবিধা, কারণ এতে খরচের কিছুটা জোগানো যায়।

আমি ডাবলিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস স্টাডিজে ভর্তি হই। এখানে এসে দেখি, শিক্ষকরা খুবই সহায়ক, আর ক্লাসের পরিবেশ খুব ফ্রেন্ডলি। তাই আপনি যদি পড়াশোনার পাশাপাশি একটি নতুন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাহলে আয়ারল্যান্ড হতে পারে আপনার জন্য আদর্শ।

আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসার জন্য কী কী লাগবে?

আমি যখন ভিসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন প্রথমে সবকিছু একটু জটিল মনে হয়েছিল। কিন্তু ধাপে ধাপে এগোলে দেখলাম, এটা আসলে খুবই সোজা। আপনার যা যা লাগবে:

  • অফার লেটার: আয়ারল্যান্ডের কোনো স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটার পেতে হবে। আমি University College Dublin (UCD)-তে আবেদন করেছিলাম এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি আবেদন করি।

  • আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ: আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনার কাছে কমপক্ষে ১০,০০০ ইউরো আছে (২০২৫ সালের নিয়ম অনুযায়ী)। আমি আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট আর স্পনসরের কাগজ জমা দিয়েছিলাম।

  • বৈধ পাসপোর্ট: পাসপোর্টের মেয়াদ কমপক্ষে ১২ মাস থাকতে হবে।

  • ইংরেজি দক্ষতা: IELTS বা TOEFL-এর মতো পরীক্ষার স্কোর লাগতে পারে। আমার IELTS স্কোর ছিল ৬.৫, যা বেশিরভাগ কোর্সের জন্য যথেষ্ট।

  • মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স: আয়ারল্যান্ডে পড়ার সময় বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য বীমা লাগে। আমি বছরে ১৫০ ইউরো দিয়ে একটি বীমা কিনেছিলাম।

  • ভিসা ফি: ভিসা আবেদনের ফি সাধারণত ৬০ ইউরো।

আমার একটি টিপস: সব কাগজপত্র আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখুন। আমি প্রথমে একটি কাগজ ভুল জমা দিয়েছিলাম, তাই প্রক্রিয়াটা একটু দেরি হয়েছিল।

আরো পড়ুন: আয়ারল্যান্ডে কাজের ভিসা

আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা খরচ: কত লাগবে?

আয়ারল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার খরচ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। আমি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সব খরচ হিসাব করে বাজেট করেছিলাম। এখানে বিস্তারিত দিচ্ছি:

  • টিউশন ফি: কোর্সের ধরনের উপর নির্ভর করে টিউশন ফি বছরে ১০,০০০ থেকে ২৫,০০০ ইউরো হতে পারে। আমার বিজনেস কোর্সের ফি ছিল ১৮,০০০ ইউরো প্রতি বছর। ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিসিনের ফি আরেকটু বেশি হতে পারে।

  • ভিসা ফি: ৬০ ইউরো (প্রায় ৭,৫০০ টাকা)।

  • জীবনযাত্রার খরচ: ডাবলিনে থাকলে মাসে ৮০০-১,২০০ ইউরো লাগে (ভাড়া, খাবার, পরিবহন মিলিয়ে)। আমি একটি শেয়ার্ড ফ্ল্যাটে থাকি, যেখানে ভাড়া মাসে ৬৫০ ইউরো।

  • স্বাস্থ্য বীমা: বছরে ১৫০-২০০ ইউরো।

  • অন্যান্য খরচ: বই, স্টেশনারি, আর মাঝেমধ্যে ঘোরাঘুরির জন্য বছরে ৫০০-১,০০০ ইউরো রাখতে হবে।

মোট হিসাবে, আমার প্রথম বছরে প্রায় ২৫,০০০ ইউরো (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) খরচ হয়েছিল। তবে আমি পার্ট-টাইম কাজ করে (ঘণ্টায় ১২-১৫ ইউরো) কিছুটা খরচ ম্যানেজ করি। আমার পরামর্শ, আগে থেকে বাজেট করে ফেলুন, এতে মানসিক চাপ কমবে।

আয়ারল্যান্ড স্টুডেন্ট ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া

আমি যখন ভিসার জন্য আবেদন করি, তখন ধাপগুলো ছিল এরকম:

  1. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি: প্রথমে আমি UCD-তে আবেদন করি। তাদের ওয়েবসাইটে সব নির্দেশনা ছিল। অফার লেটার পেতে আমার ৪ সপ্তাহ লেগেছিল।

  2. কাগজপত্র প্রস্তুত: পাসপোর্ট, অফার লেটার, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, IELTS স্কোর, এবং স্বাস্থ্য বীমার কাগজ জমা দিতে হয়। আমি সবকিছু একটি ফোল্ডারে সাজিয়ে রেখেছিলাম।

  3. অনলাইন আবেদন: আয়ারল্যান্ডের ভিসা আবেদন www.visas.inis.gov.ie ওয়েবসাইটে করতে হয়। আমি ফর্ম পূরণ করে ফি জমা দিয়েছিলাম।

  4. VFS Global-এ জমা: বাংলাদেশে আইরিশ দূতাবাস না থাকায় আমি ভারতের নয়াদিল্লিতে VFS অফিসে কাগজপত্র জমা দিই। এটি একটু ঝামেলার ছিল, তবে তাদের স্টাফ খুব সহায়ক ছিল।

  5. প্রসেসিং: ভিসা প্রক্রিয়ায় ৪-৮ সপ্তাহ লাগে। আমার ক্ষেত্রে ৬ সপ্তাহ লেগেছিল।

একটি জিনিস মনে রাখবেন, সব কাগজ সঠিকভাবে জমা দিলে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমি একবার ভুল করে একটি পুরানো ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম, তাই একটু ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল।

আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনার সময় কাজের সুযোগ

আমার জন্য আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ। স্টুডেন্ট ভিসায় আপনি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন (ছুটির সময় ৪০ ঘণ্টা)। আমি ডাবলিনের একটি ক্যাফেতে পার্ট-টাইম কাজ শুরু করি। ঘণ্টায় ১২.৫০ ইউরো পেতাম, যা আমার ভাড়া আর খাবারের খরচ মেটাতে সাহায্য করত।

কাজ খুঁজতে আমি Indeed.ie আর Jobs.ie-এর মতো ওয়েবসাইট ব্যবহার করেছি। তাছাড়া, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার সেন্টারও অনেক সাহায্য করেছিল। তবে একটি কথা বলে রাখি, কাজের সঙ্গে পড়াশোনার ভারসাম্য রাখা একটু চ্যালেঞ্জিং। আমি প্রথমে একটু হিমশিম খেয়েছিলাম, কিন্তু পরে সময় ব্যবস্থাপনা শিখে নিই।

আয়ারল্যান্ডে জীবনযাত্রা: আমার অভিজ্ঞতা

ডাবলিনে এসে প্রথম যে জিনিস আমাকে মুগ্ধ করেছিল, তা হলো এখানকার প্রকৃতি আর মানুষের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। তবে খরচ একটু বেশি, বিশেষ করে ভাড়া। আমি একটি শেয়ার্ড ফ্ল্যাটে থাকি, যেখানে আমার তিনজন ফ্ল্যাটমেট আছে। আমরা মিলে রান্না করি, যাতে খরচ কম হয়।

এখানকার আবহাওয়া একটু অভ্যস্ত হতে সময় লাগে। প্রায়ই বৃষ্টি হয়, তাই একটা ভালো জ্যাকেট আর ছাতা সবসময় সঙ্গে রাখি। তবে শীতকালে আলোর উৎসব আর গ্রীষ্মে পার্কগুলোর সৌন্দর্য ভোলার মতো না।

আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনার পর কী?

আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনা শেষে আপনি Stay Back Visa (Stamp 1G) পেতে পারেন, যা আপনাকে ২ বছর পর্যন্ত থাকার আর কাজ করার সুযোগ দেয়। আমি এখনো আমার কোর্স শেষ করিনি, তবে আমার এক সিনিয়র এই ভিসায় একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। এটি আমার জন্যও একটি বড় প্রেরণা।

তাছাড়া, আয়ারল্যান্ডে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, যেমন Google, Facebook, আর Apple। তাই ক্যারিয়ার গড়ার জন্য এটি দারুণ জায়গা। আমি ইতোমধ্যে কয়েকটি ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করেছি, দেখি কী হয়!

আমার কিছু ব্যক্তিগত পরামর্শ

  • আগে থেকে গবেষণা করুন: বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্স, আর খরচ নিয়ে ভালোভাবে খোঁজ নিন। আমি প্রথমে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিধায় ছিলাম, তাই তাদের সঙ্গে ইমেইল করে সব জেনে নিয়েছিলাম।

  • প্রতারণা থেকে সাবধান: কিছু এজেন্সি বেশি টাকা চায়। আমি শুনেছি, কেউ কেউ ৫-৬ লাখ টাকা দিয়েও ঝামেলায় পড়েছে। সরকারি ওয়েবসাইট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আবেদন করুন।

  • ইংরেজি দক্ষতা বাড়ান: এখানে পড়তে আর কাজ করতে ইংরেজি খুব জরুরি। আমি IELTS-এর আগে অনলাইনে প্র্যাকটিস করেছিলাম।

  • নেটওয়ার্কিং: বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে যোগ দিন। আমি একটি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ক্লাবে যোগ দিয়ে অনেক বন্ধু পেয়েছি, যারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

শেষ কথা

আয়ারল্যান্ডে পড়তে আসা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিল। এখানকার শিক্ষা, কাজের সুযোগ, আর জীবনযাত্রা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি আশা করি, আমার এই অভিজ্ঞতা আপনার জন্য একটু হলেও সাহায্য করবে। আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, আমাকে জানান। আমি চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব সাহায্য করতে। আয়ারল্যান্ডে আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য শুভকামনা!

আমাদের আরও কিছু পোস্ট সমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *