ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা

ইতালি, ইউরোপের একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছেন। আপনি যদি ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা যোগ্যতা, ইতালিতে পড়াশোনার খরচ, বা ইতালিতে স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে কত টাকা লাগে জানতে চান, তাহলে এই আর্টিকেল আপনার জন্য।

এই আর্টিকেলে আমরা ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা ২০২৫ সম্পর্কে ধাপে ধাপে গাইড, যোগ্যতা, আবেদন প্রক্রিয়া, খরচ, এবং পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ নিয়ে আলোচনা করবো। তাছাড়া, প্রতারণা এড়ানোর টিপস এবং ভিসা স্ট্যাটাস চেক করার উপায়ও শেয়ার করবো।

আরও জানুন: ইতালিতে কাজের সুযোগ সম্পর্কে জানতে ইতালি ওয়ার্ক পারমিট ভিসা পেজটি দেখুন।

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা কী?

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা (ইতালিয়ান ভাষায় Visto per Studio) হলো একটি ভিসা, যা বিদেশি শিক্ষার্থীদের ইতালিতে পড়াশোনার জন্য বৈধভাবে থাকার অনুমতি দেয়। এই ভিসা সাধারণত নন-ইইউ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য, যেমন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। এটি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রোগ্রামের জন্য ইস্যু করা হয়, যেমন:

  • স্নাতক (Bachelor’s)।
  • স্নাতকোত্তর (Master’s)।
  • ডক্টরেট (PhD)।
  • ভাষা কোর্স বা ভোকেশনাল ট্রেনিং।

ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেমন University of Bologna, Sapienza University of Rome, এবং Politecnico di Milano, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং তুলনামূলক কম টিউশন ফি-এর জন্য জনপ্রিয়।

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসার প্রকারভেদ

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা দুই ধরনের হতে পারে, কোর্সের মেয়াদের উপর নির্ভর করে:

  1. শর্ট-টার্ম স্টুডেন্ট ভিসা (Type C):
    • মেয়াদ: ৯০ দিন পর্যন্ত।
    • কোর্স: স্বল্পমেয়াদি ভাষা কোর্স বা ট্রেনিং।
  2. লং-টার্ম স্টুডেন্ট ভিসা (Type D):
    • মেয়াদ: ৯০ দিনের বেশি, সাধারণত ১ বছর (নবায়নযোগ্য)।
    • কোর্স: স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বা ডক্টরেট প্রোগ্রাম।

বাংলাদেশিদের জন্য: লং-টার্ম স্টুডেন্ট ভিসা (Type D) সবচেয়ে জনপ্রিয়, কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ভর্তি হন।

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসার যোগ্যতা

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা পেতে নিম্নলিখিত যোগ্যতা পূরণ করতে হবে:

  1. বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি:
    • ইতালির কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির নিশ্চয়তা (Admission Letter)।
    • কোর্সটি অবশ্যই ফুল-টাইম হতে হবে।
  2. শিক্ষাগত যোগ্যতা:
    • স্নাতকের জন্য: এইচএসসি বা সমমান (ন্যূনতম ৬০% নম্বর)।
    • স্নাতকোত্তরের জন্য: স্নাতক ডিগ্রি (CGPA ৩.০০ বা তার বেশি)।
    • ভাষা কোর্সের জন্য: সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না।
  3. আর্থিক সক্ষমতা:
    • বছরে ন্যূনতম ৬,০০০ ইউরো (প্রায় ৭,৫০,০০০ টাকা, ১ ইউরো = ১২৫ টাকা) খর ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা স্পনসরের আর্থিক নথি।
  4. ভাষার দক্ষতা:
    • ইংরেজি-মাধ্যম কোর্সের জন্য: IELTS (৬.০ বা তার বেশি) বা TOEFL।
    • ইতালিয়ান-মাধ্যম কোর্সের জন্য: CILS বা CELI সার্টিফিকেট।
  5. স্বাস্থ্য বীমা:
    • ইতালিতে থাকাকালীন বৈধ স্বাস্থ্য বীমা (ন্যূনতম কভারেজ ৩০,০০০ ইউরো)।
  6. পাসপোর্ট:
    • বৈধ পাসপোর্ট (মেয়াদ কমপক্ষে ৬ মাস এবং ২টি ফাঁকা পৃষ্ঠা)।
  7. অপরাধমুক্ত রেকর্ড:
    • পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট।

নোট: কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের জন্য অতিরিক্ত শর্ত চাইতে পারে।

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা পেতে নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

ধাপ ১: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি

  • ইতালির স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করুন এবং ভর্তির নিশ্চয়তা পান।
  • ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট বা Universitaly পোর্টাল (https://www.universitaly.it/) ব্যবহার করুন।
  • সময়: বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের শেষ তারিখ এপ্রিল-জুন।

ধাপ ২: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ

নিচের টেবিলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা দেওয়া হলো:

কাগজপত্রবিস্তারিত
পাসপোর্টমেয়াদ কমপক্ষে ৬ মাস এবং ২টি ফাঁকা পৃষ্ঠা।
ভর্তির চিঠিবিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অফিসিয়াল Admission Letter।
শিক্ষাগত সনদএইচএসসি, স্নাতক সার্টিফিকেট (নোটারাইজড কপি)।
ট্রান্সক্রিপ্টশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত মার্কশিট।
ভাষার সার্টিফিকেটIELTS/TOEFL বা CILS/CELI।
আর্থিক প্রমাণব্যাংক স্টেটমেন্ট বা স্পনসরের নথি (৬,০০০ ইউরো/বছর)।
স্বাস্থ্য বীমান্যূনতম ৩০,০০০ ইউরো কভারেজ।
ছবি৩৫x৪৫ মিমি, সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড, সাম্প্রতিক।
ভিসা ফি৫০ ইউরো (প্রায় ৬,২৫০ টাকা, ১ ইউরো = ১২৫ টাকা)।
পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসাম্প্রতিক এবং সত্যায়িত।

ধাপ ৩: VFS Global-এ আবেদন

  • বাংলাদেশে অবস্থিত VFS Global অফিসে গিয়ে ভিসা আবেদন করুন।
  • ঠিকানা: VFS Global, ঢাকা (বিস্তারিত: https://visa.vfsglobal.com/bgd/en/ita/)।
  • অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন এবং নির্ধারিত তারিখে কাগজপত্র জমা দিন।
  • বিস্তারিত জানতে ইতালি ভিসা আবেদন পেজটি দেখুন।

ধাপ ৪: বায়োমেট্রিক তথ্য জমা

  • VFS Global-এ আঙুলের ছাপ এবং ছবি জমা দিন।
  • এটি ভিসা প্রক্রিয়ার বাধ্যতামূলক অংশ।

ধাপ ৫: ভিসা প্রক্রিয়াকরণ

  • আবেদন জমা দেওয়ার পর ইতালি দূতাবাস ভিসা প্রক্রিয়া করবে।
  • সময়: ১৫-৪৫ দিন (কোর্স এবং আবেদনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে)।
  • স্ট্যাটাস চেক করতে ইতালি ভিসা চেক পেজটি দেখুন।

ধাপ ৬: ভিসা গ্রহণ ও ইতালি যাত্রা

  • ভিসা অনুমোদিত হলে, VFS Global থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করুন।
  • ইতালিতে পৌঁছানোর পর ৮ দিনের মধ্যে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে Permesso di Soggiorno (রেসিডেন্স পারমিট) এর জন্য আবেদন করুন।

ইতালিতে স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে কত টাকা লাগে?

ইতালিতে স্টুডেন্ট ভিসায় যাওয়ার খরচ বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে। ২০২৫ সালে গড় খরচ নিম্নরূপ:

খরচের ধরনপরিমাণ (টাকা)
ভিসা ফি৬,২৫০ (৫০ ইউরো)
VFS সার্ভিস ফি৩,১২৫-৩,৭৫০ (২৫-৩০ ইউরো)
স্বাস্থ্য বীমা১২,৫০০-২৫,০০০ (১০০-২০০ ইউরো)
বিমান ভাড়া৫০,০০০-১,০০,০০০
এজেন্সি ফি (ঐচ্ছিক)১,০০,০০০-৩,০০,০০০
মোট (গড়)২,০০,০০০-৪,৫০,০০০

টিপস: খরচ কমাতে সরাসরি VFS Global-এ আবেদন করুন এবং বৃত্তি বা ফান্ডিংয়ের জন্য আবেদন করুন। বিস্তারিত জানতে ইতালি ভিসা খরচ পেজ দেখুন।

ইতালিতে পড়াশোনার খরচ

ইতালিতে পড়াশোনার খরচ বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্স, এবং শহরের উপর নির্ভর করে। ২০২৫ সালে গড় খরচ নিম্নরূপ:

  1. টিউশন ফি:
    • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: ৯০০-৪,০০০ ইউরো/বছর (১,১২,৫০০-৫,০০,০০০ টাকা)।
    • প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়: ৬,০০০-২০,০০০ ইউরো/বছর (৭,৫০,০০০-২৫,০০,০০০ টাকা)।
    • বৃত্তি: অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করে (৫,০০০-১০,০০০ ইউরো/বছর)।
  2. জীবনযাত্রার খরচ:
    • থাকা (ভাড়া): ৩০০-৮০০ ইউরো/মাস (৩৭,৫০০-১,০০,০০০ টাকা)।
    • খাবার: ১৫০-৩০০ ইউরো/মাস (১৮,৭৫০-৩৭,৫০০ টাকা)।
    • পরিবহন: ২৫-৫০ ইউরো/মাস (৩,১২৫-৬,২৫০ টাকা)।
    • মোট: ৬০০-১,২০০ ইউরো/মাস (৭৫,০০০-১,৫০,০০০ টাকা)।
  3. অন্যান্য খরচ:
    • বই ও স্টেশনারি: ১০০-২০০ ইউরো/বছর (১২,৫০০-২৫,০০০ টাকা)।
    • বিনোদন: ৫০-১০০ ইউরো/মাস (৬,২৫০-১২,৫০০ টাকা)。

টিপস: ছোট শহরে (যেমন পিসা, পাদোভা) জীবনযাত্রার খরচ কম। মিলান বা রোমে খরচ বেশি।

ইতালিতে পার্ট-টাইম কাজ

ইতালিতে স্টুডেন্ট ভিসায় পড়াশোনার পাশে পার্ট-টাইম কাজ করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা নিম্নলিখিত শর্তে কাজ করতে পারেন:

  • কাজের সময়: সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা (বছরে মোট ১,০৪০ ঘণ্টা)।
  • জনপ্রিয় কাজ:
    • রেস্টুরেন্টে ওয়েটার/কিচেন হেল্পার।
    • টিউটরিং (ইংরেজি বা অন্য ভাষা)।
    • ফ্রিল্যান্সিং (গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং)।
    • দোকানে সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট।
  • বেতন: ঘণ্টায় ৮-১২ ইউরো (১,০০০-১,৫০০ টাকা)।
  • নোট: ইতালিয়ান ভাষা জানলে কাজ পাওয়া সহজ।

বিস্তারিত: পার্ট-টাইম কাজের বেতন সম্পর্কে জানতে ইতালি সর্বনিম্ন বেতন পেজটি দেখুন।

প্রতারণা এড়ানোর টিপস

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা প্রক্রিয়ায় প্রতারণা এড়াতে নিম্নলিখিত টিপস মেনে চলুন:

  • শুধুমাত্র সরকারি বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করুন।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে ভর্তির তথ্য যাচাই করুন।
  • ভুয়া ভর্তির চিঠি বা অতিরিক্ত ফি প্রদান এড়িয়ে চলুন।
  • ভিসা আবেদনের স্ট্যাটাস নিয়মিত চেক করুন। বিস্তারিত জানতে ইতালি ভিসা চেক পেজ দেখুন।
  • দালালের দেওয়া চুক্তিপত্র এবং লাইসেন্স যাচাই করুন।

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা সম্পর্কিত FAQ

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা পেতে কত সময় লাগে?

১৫-৪৫ দিন।

ইতালিতে পড়াশোনার গড় খরচ কত?

৮,০০,০০০-১৫,০০,০০০ টাকা/বছর (টিউশন ও জীবনযাত্রা সহ)।

স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করা যায়?

হ্যাঁ, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পার্ট-টাইম কাজ করা যায়।

ভিসা ফি কত?

৫০ ইউরো (প্রায় ৬,২৫০ টাকা)।

ইতালিতে বৃত্তি পাওয়া যায়?

হ্যাঁ, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ৫,০০০-১০,০০০ ইউরো/বছর বৃত্তি পেতে পারেন।

ইতালিয়ান ভাষা না জানলে পড়াশোনা সম্ভব?

হ্যাঁ, অনেক কোর্স ইংরেজি-মাধ্যমে পড়ানো হয়।

শেষ কথা

ইতালি স্টুডেন্ট ভিসা ২০২৫ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং ক্যারিয়ার গড়ার একটি দুর্দান্ত সুযোগ। সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে আবেদন করলে আপনি সহজেই এই ভিসা পেতে পারেন। ইতালিয়ান ভাষা শিখে এবং পার্ট-টাইম কাজ করে আপনি পড়াশোনার খরচ ম্যানেজ করতে পারবেন। প্রতারণা এড়াতে সতর্ক থাকুন এবং ভিসা স্ট্যাটাস নিয়মিত চেক করুন।

আরও তথ্যের জন্য সার্বিয়া থেকে ইতালি গাইড পেজ দেখুন। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানান।

আমাদের আরও কিছু পোস্ট সমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *