গত বছর আমি যখন ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন আমার মাথায় প্রথম প্রশ্ন এসেছিল—বাংলাদেশ থেকে ওমান যেতে কত টাকা লাগে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি অনেক তথ্য জোগাড় করেছি, অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং নিজে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আজ এই আর্টিকেলে আমি আমার সেই অভিজ্ঞতা এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনাদের জন্য একটি সহজ গাইড তৈরি করছি। এখানে আমি ওমান ভিসার দাম কত, ওমান যেতে কী কী লাগে, এবং খরচ কমানোর উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

আমার লক্ষ্য হলো এমনভাবে লেখা যাতে আপনারা সবকিছু সহজে বুঝতে পারেন এবং ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!


কেন ওমানে যাবেন?

ওমান, মধ্যপ্রাচ্যের একটি সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ দেশ। আমি যখন ওমান সম্পর্কে জানতে শুরু করি, তখন দেখলাম এখানে কাজের সুযোগ, ভালো বেতন, এবং নিরাপদ পরিবেশ আছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ওমানে যান—কেউ কাজের জন্য, কেউ পড়াশোনার জন্য, আর কেউ বা ভ্রমণের জন্য। ওমানের সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এবং আধুনিক জীবনযাত্রা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল।

তবে যাওয়ার আগে একটা জিনিস মাথায় রাখা জরুরি—ওমানে প্রবেশের জন্য বৈধ ভিসা লাগবে। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে ভিসার ধরন নির্ধারিত হয়। আমি নিজে কাজের জন্য গিয়েছিলাম, তাই ওয়ার্ক পারমিট ভিসার প্রক্রিয়া নিয়ে বেশি জানি। চলুন, এবার ভিসার ধরন নিয়ে জানি।


ওমান ভিসার ধরন

ওমানে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিসা পাওয়া যায়। আমি যখন প্রথম আবেদন করতে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম ভিসার ধরন বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভিসার ধরনের ওপরই খরচ এবং প্রক্রিয়া নির্ভর করে। এখানে প্রধান ভিসাগুলোর কথা বলছি:

  1. ওয়ার্ক পারমিট ভিসা:
    এটি তাদের জন্য যারা ওমানে কাজ করতে চান। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে এই ভিসার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আমি এই ভিসায় গিয়েছিলাম। নির্মাণ, ড্রাইভিং, হোটেল, এবং ইলেকট্রিশিয়ানের মতো কাজের জন্য এটি জনপ্রিয়।

  2. স্টুডেন্ট ভিসা:
    ওমানে পড়াশোনা করতে চাইলে এই ভিসা লাগবে। এটি তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়।

  3. ভিজিট বা টুরিস্ট ভিসা:
    যারা ওমানে ঘুরতে যেতে চান, তাদের জন্য এই ভিসা। এটি সাধারণত ৩ মাসের জন্য দেওয়া হয়। আমার এক বন্ধু এই ভিসায় গিয়ে ওমানের সৌন্দর্য উপভোগ করেছিল।

  4. ফ্যামিলি ভিসা:
    যারা ওমানে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে চান, তাদের জন্য এই ভিসা। এটি পেতে একটু বেশি ডকুমেন্ট লাগে।

আপনি যদি সঠিক ভিসা বেছে নিতে পারেন, তাহলে পরবর্তী প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।


ওমান ভিসার দাম কত ২০২৫

এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে—ওমান ভিসার দাম কত? আমি যখন এজেন্সির সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন দেখলাম ভিসার দাম ভিসার ধরন এবং প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। ২০২৫ সালের হিসাবে এখানে আনুমানিক খরচ দেওয়া হলো:

ভিসার ধরন

খরচ (বাংলাদেশি টাকা)

ওয়ার্ক পারমিট ভিসা

৩,০০,০০০ – ৫,০০,০০০

স্টুডেন্ট ভিসা

৫০,০০০ – ১,০০,০০০

ভিজিট/টুরিস্ট ভিসা

৫০,০০০ – ৮০,০০০

ফ্যামিলি ভিসা

৩,০০,০০০ – ৩,৫০,০০০

কিছু জিনিস মাথায় রাখুন:

  • ওয়ার্ক পারমিট ভিসা সবচেয়ে ব্যয়বহুল কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কাজের সঙ্গে জড়িত। আমি ৪ লাখ টাকার মতো খরচ করেছিলাম।

  • স্টুডেন্ট এবং ভিজিট ভিসা তুলনামূলক সস্তা।

  • এজেন্সির ফি, মেডিকেল টেস্ট, এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের খরচ আলাদাভাবে যোগ হতে পারে।

আমার একটা টিপস—এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করার আগে সব খরচের হিসাব লিখিতভাবে নিয়ে নিন। এতে পরে ঝামেলা কম হবে।


ওমান যেতে মোট কত টাকা লাগে?

শুধু ভিসার দামই নয়, ওমান যাওয়ার জন্য আরও কিছু খরচ আছে। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম মোট খরচের মধ্যে এই জিনিসগুলো যোগ হয়:

  1. ভিসা ফি: ওপরে উল্লেখ করা দাম।

  2. বিমান টিকেট: ঢাকা থেকে মাস্কাটের টিকেট সাধারণত ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকার মধ্যে থাকে। আমি আগে থেকে বুক করে ৪৫,০০০ টাকায় পেয়েছিলাম।

  3. মেডিকেল টেস্ট: ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা।

  4. পুলিশ ক্লিয়ারেন্স: ২,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা।

  5. এজেন্সি ফি: ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা (এজেন্সির ওপর নির্ভর করে)।

  6. প্রাথমিক খরচ: ওমানে পৌঁছে থাকা-খাওয়ার জন্য ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা।

মোট খরচের হিসাব:

  • ওয়ার্ক পারমিট ভিসা: ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা।

  • স্টুডেন্ট/ভিজিট ভিসা: ১ থেকে ২ লাখ টাকা।

আমার ক্ষেত্রে মোট ৬ লাখ টাকার মতো লেগেছিল, কারণ আমি এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলাম। তবে সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে এই খরচ ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায় নামতে পারে।


ওমান ভিসার জন্য কী কী প্রয়োজন?

আমি যখন ভিসার জন্য ডকুমেন্ট তৈরি করছিলাম, তখন বুঝলাম সঠিক কাগজপত্র ছাড়া ভিসা পাওয়া অসম্ভব। এখানে ওমান ভিসার জন্য যা যা লাগে:

  • পাসপোর্ট: কমপক্ষে ৬ মাস মেয়াদ থাকতে হবে। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছিল।

  • পাসপোর্ট সাইজ ছবি: সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে ২-৩ কপি।

  • মেডিকেল সার্টিফিকেট: ওমান সরকার নির্দিষ্ট ক্লিনিক থেকে টেস্ট করতে বলে।

  • পুলিশ ক্লিয়ারেন্স: এটি পেতে আমার ৭-১০ দিন লেগেছিল।

  • জব অফার লেটার: ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য এটি বাধ্যতামূলক।

  • শিক্ষাগত সনদ: কাজের ধরন অনুযায়ী লাগতে পারে।

  • ভিসা আবেদন ফর্ম: সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে।

আমার পরামর্শ: সব ডকুমেন্ট একবার চেক করে নিন। আমার এক বন্ধুর আবেদন বাতিল হয়েছিল শুধু একটা কাগজ ভুল থাকার জন্য।


ওমানে কাজের সুযোগ ও বেতন

ওমানে কাজের বাজার বেশ ভালো। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম নির্মাণ, ড্রাইভিং, এবং হোটেলের কাজের চাহিদা বেশি। এখানে কিছু জনপ্রিয় কাজের বেতনের হিসাব দিচ্ছি (২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী):

কাজের ধরন

বেতন (ওমানি রিয়াল)

বাংলাদেশি টাকা (প্রায়)

রাজমিস্ত্রী

৩০০ – ৪০০

৮৫,০০০ – ১,১৫,০০০

ইলেকট্রিশিয়ান

২৮০ – ৩৬০

৭৮,০০০ – ১,০২,০০০

ড্রাইভার

১৫০ – ২০০

৪৩,০০০ – ৫৭,০০০

শেফ

২০০ – ২৫০

৫৭,০০০ – ৭২,০০০

আমার অভিজ্ঞতা: আমি একটি নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করছি এবং প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ টাকার মতো বেতন পাই। তবে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকলে বেতন আরও বাড়তে পারে।


কীভাবে ওমান যাওয়ার খরচ কমানো যায়?

ওমানে যাওয়ার খরচ কমানোর জন্য আমি কিছু কৌশল শিখেছিলাম। এখানে সেগুলো শেয়ার করছি:

  1. সরাসরি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করুন:
    মধ্যস্থতাকারী বা দালাল এড়িয়ে সরাসরি ওমানের কোম্পানির সঙ্গে কথা বললে ৫০,০০০ থেকে ১ লাখ টাকা বাঁচতে পারে। আমি একটি কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি আবেদন করেছিলাম।

  2. বিশ্বস্ত এজেন্সি বেছে নিন:
    এজেন্সি ছাড়া অনেক সময় কাজ পাওয়া কঠিন। তবে এমন এজেন্সি বেছে নিন যাদের ভালো রিভিউ আছে। আমি আমার এজেন্সি গুগল রিভিউ দেখে ঠিক করেছিলাম।

  3. টিকেট আগে থেকে বুক করুন:
    ফ্লাইটের দাম কমানোর জন্য ২-৩ মাস আগে টিকেট বুক করুন। এতে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা বাঁচবে।

  4. সরকারি প্রক্রিয়া ব্যবহার করুন:
    বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গেলে খরচ অনেক কম হয়। আমার এক বন্ধু এভাবে গিয়ে ১ লাখ টাকার বেশি বাঁচিয়েছিল।


ওমান ভ্রমণের প্রস্তুতি ও সময়

বাংলাদেশ থেকে ওমানের দূরত্ব প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন নন-স্টপ ফ্লাইটে ৫ ঘণ্টার মতো লেগেছিল। তবে স্টপওভার ফ্লাইটে ৮-১২ ঘণ্টাও লাগতে পারে।

প্রস্তুতির জন্য আমার টিপস:

  • ভিসা, টিকেট, এবং ডকুমেন্ট তিনবার চেক করুন।

  • ওমানে পৌঁছে প্রথম সপ্তাহের জন্য কিছু টাকা হাতে রাখুন।

  • ওমানের আবহাওয়া গরম, তাই হালকা কাপড় নিয়ে যান।


ওমান ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া

আমি যখন ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম, তখন প্রক্রিয়াটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। এখানে ধাপগুলো সহজভাবে বলছি:

  1. কোম্পানি খুঁজুন: কাজের জন্য হলে ওমানের কোম্পানি থেকে জব অফার লেটার নিন।

  2. ডকুমেন্ট জমা দিন: এজেন্সি বা দূতাবাসে সব কাগজপত্র জমা দিন।

  3. মেডিকেল টেস্ট করান: নির্দিষ্ট ক্লিনিক থেকে টেস্ট করতে হবে।

  4. ভিসা ফি জমা দিন: এজেন্সি বা কোম্পানির মাধ্যমে ফি দিন।

  5. ভিসার জন্য অপেক্ষা করুন: সাধারণত ১৫-৩০ দিন লাগে।

আমার ক্ষেত্রে ২০ দিনের মতো সময় লেগেছিল ভিসা হাতে পেতে।

আরো জানুন: পাসপোর্ট নাম্বার দিয়ে ওমানের ভিসা চেক


সতর্কতা ও প্রতারণা এড়ানোর উপায়

আমি শুনেছি অনেকে এজেন্সির কাছে প্রতারিত হয়েছেন। আমার একটি পরামর্শ—কখনো অগ্রিম বেশি টাকা দিয়ে ফেলবেন না। এছাড়া:

  • এজেন্সির লাইসেন্স চেক করুন।

  • জব অফার লেটার ভালোভাবে পড়ুন।

  • পরিচিত কারও মাধ্যমে এজেন্সি খুঁজুন।

আমি নিজে একটি নামকরা এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলাম, তাই ঝামেলায় পড়িনি।


শেষ কথা

ওমানে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই। আমি নিজে গিয়ে বুঝেছি, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এই যাত্রা জীবন বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে ওমান যেতে কত টাকা লাগে এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনার ভিসার ধরন এবং প্রক্রিয়ার ওপর। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, সবকিছু আগে থেকে জেনে নিন, বিশ্বস্ত লোকের সঙ্গে কাজ করুন, এবং ধৈর্য ধরুন।

আশা করি, এই আর্টিকেলটি আপনার ওমান যাওয়ার পথকে আরও সহজ করবে। আপনার যাত্রা শুভ হোক! যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, কমেন্টে জানান। আমি চেষ্টা করব উত্তর দিতে।

আমাদের আরও কিছু পোস্ট সমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *